Friday, August 14, 2015

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ :: বাংলাদেশকে মরুকরনে নয়া উদ্যোগ ম. ইনামুল হক

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ :: বাংলাদেশকে মরুকরনে নয়া উদ্যোগ

ইনামুল হক
Dis 3
গত ১৩ জুলাই ২০১৫ ভারত সরকারের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধ্যাপক সানোয়ার লাল জাট পানি সমৃদ্ধ রাজ্যগুলোকে সদিচ্ছা এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার প্রতি আগ্রহী হতে বলেছেন। তিনি নয়াদিল্লীতে আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার বিশেষ কমিটির ৫ম সভায় বলেনএই মেগা প্রকল্পটি বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে দেশের পানি ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার করবে। ঐ সভায় মধ্য ভারতের চলতি অন্যান্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। মন্ত্রী বলেনতাঁর মন্ত্রণালয় খুব শীগগীরই মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পটি নিয়ে আসামপশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের সাথে আলাপ করে কাজ শুরু করবেন। এই প্রকল্পটি আসামপশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে শুধুমাত্র সেচ ও পািন সরবরাহের সুবিধাই নয়এক বিরাট পরিমান পানি দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে সরবরাহ করতে পারবে।
উল্লেখ্য যেস্বাধীনতার পর উনিশশ পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভারতের পরিকল্পনাবিদরা দেশব্যাপী আন্তঃনদী সংযোগের প্রস্তাব করে। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে Indus Waters Treatyস্বাক্ষরিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে কোন সমঝোতা বাদেই ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭৫ সালে এই ব্যারেজ চালু করে পানি প্রত্যাহার শুরু হলে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৭৭ সালের পানি বন্টন চুক্তিতে পানির যে ভাগাভাগি হয় তা ভারতের কাছে চূড়ান্তভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। কারণ ঐ চুক্তিতে শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবরাহের গ্যারান্টি দেয়া ছিল। এরপরই ভারত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি এনে গঙ্গা নদীতে ফেলা তথা আন্তঃনদী সংযোগ প্রস্তাব করতে থাকে। ভারতের প্রস্তাব ছিলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে একটি খাল কেটে ফারাক্কার উজানে ফেলতে হবে। কিন্তু এতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘড়বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করতে হতো এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হতো। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। ফলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় এবং চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর পার হলে আর নতুন চুক্তি হয়নি।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে শুকনা মৌসুমে গঙ্গা নদীর ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ছিলো প্রায় এক লক্ষ কিউসেক। ১৯৭৭ সালের গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ন্যুনতম ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি সরবরাহের গ্যারান্টি ছিলো। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে সর্বনিম্ন ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা বলা হয়েছেকিন্তু কোন গ্যারান্টি দেয়া হয়নি। এরপর ১৯৯৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এলে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাটি পুনরায় জেগে ওঠে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অখন্ড ভারত ও হিন্দুত্বের জিগির এবং দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহে পরিকল্পনাটি অচিরেই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মোট ৩০টি ক্যানাল সিস্টেমের ঐ প্রকল্পে বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত (বছরের গড় বৃষ্টিপাত ৩৫০০ মিলিমিটারথেকে পানি খাল কেটে সরিয়ে নিয়ে পশ্চিম ভারতে (বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৭০০ মিলিমিটারএবং দক্ষিণ ভারতে (বছরে গড় বৃষ্টিপাত ১০০০ মিলিমিটারপাঠানোর কথা রয়েছে। কিন্তু বিহারআসামপশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যের জনগণ ও বুদ্ধিজীবীরা বাধ সাধে। কারণ এই পরিকল্পনাতে তাদের তো কোন উপকার নেইই বরং আছে কোটি কোটি মানুষের উচ্ছেদ আর পরিবেশ বিপর্যয়।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের শুরু আসামের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে। এই নদীর পানি অন্যত্র সরাতে হলে গৌহাটি অথবা গোয়ালপাড়াতে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ব্যারেজ নির্মাণ করতে হবে। এই ব্যারেজ আসামের বন্যার পানি দ্রুত সরে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে। তাছাড়া পানি সরাতে সংযোগ প্রকল্পের ১৪ নং খালটির মাধ্যমে আসামের বরপেটাকোকড়াঝড় ও ধুবড়ী জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবেযা এই এলাকার কোন উপকারে তো আসবেই না বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশ বিপর্যয় হবে।
পশ্চিমবঙ্গ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ১ নং খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পানি এই অঞ্চল দিয়ে নিতে হলে প্রায় ১০০ মিটার উঁচুতে তুলে ডুয়ার্সের উচ্চভূমি দিয়ে পার করতে হবে। এটি অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারজলপাইগুড়িদার্জিলিংউত্তর দিনাজপুর ও মালদহ জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে। যা লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশ বিপর্যয় হবে। ব্রহ্মপুত্র থেকে গঙ্গায় আনা পানি ১০ নং সংযোগ খালের মাধ্যমে বীরভুমবাঁকুড়া,মেদিনীপুর জেলাগুলোর উপর দিয়ে খাল কেটে দক্ষিণ ভারতে নেয়া হবেযা লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্ছেদ করবে ও পরিবেশ বিপর্যয় হবে। তা'ছাড়া দীর্ঘ পথে পাড়ি দিতে সংগৃহীত পানির সিংহভাগই বাষ্পীভবন হয়ে উবে যাবে।
বিহার সমভুমি বিহারের নদীগুলোতে যে পানি আছে তা এই এলাকার জন্য যথেষ্ট। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ১২২ নং খালের মাধ্যমে মেচি ও কোশী নদীর পানি বিহারের তরাই অঞ্চল দিয়ে এবং ৩ নং খাল দিয়ে গন্ডক নদীর পানি সমভুমির উপর দিয়ে গঙ্গায় ফেলা হবে। এতে এসকল নদীর অববাহিকার জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে যা এই এলাকার কোন উপকারে তো আসবে।
বাংলাদেশ বাংলাদেশে শুকনা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ৮০চাহিদা পূরণ করেযার উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের কৃষি ও জীব পরিবেশ গড়ে উঠেছে। অতএব এর একটা বিরাট অংশ ভারতের পশ্চিমে চালান করলে বাংলাদেশে বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় হবে। সমুদ্রের লবনাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ,মধুমতির কামারখালীধলেশ্বরীর মাণিকগঞ্জ এবং মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। মিষ্টি পানির অভাবে সারা দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার ভূতল জীব এবং জনজীবন ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে। মোহনা এলাকার জীববৈচিত্রমৎস্য এবং পানিসম্পদ বিপর্যস্ত হবে।
 Dis 3-1
তাই ভারত সরকারের পরিকল্পনা প্রকাশের পর ভারতীয় এবং বাংলাদেশের মিডিয়ায় তা' প্রকাশ হলে এক তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং উভয় দেশের পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি নিয়ে নড়ে চড়ে বসছে। জানা গেছে যেবাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকারের কাছে একটি পত্র দেয়া হবে। বাস্তবতা এই যেভারত ইতিমধ্যে একটি সংযোগ খাল কেটে তিস্তা নদীর পানি গঙ্গা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। ভারত যদি এভাবে আন্তঃনদী সংযোগের কাজে এগোয় বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে। ভারত সরকারও যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বস্তির মধ্যে থাকবে তা' নয়। প্রকল্পটি আসাম থেকে উত্তর প্রদেশব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রাজস্থানগুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের জনগণকে লাভবান করবে বিধায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণ এতে বাধা দেবে। বাংলাদেশের জনগণ ভারতের জনগণকে এই লড়াইয়ে অবশ্যই সমর্থন দেবে।।
(প্রকৌশলী মইনামুল হকপানি বিশেষজ্ঞ)
minamul@gmail.com

__._,_.___

--
Pl see my blogs;


Feel free -- and I request you -- to forward this newsletter to your lists and friends!

No comments: