Wednesday, August 20, 2014

সারদা কাণ্ডে গ্রেফতার ইস্টবেঙ্গল-কর্তা

সিবিআই থাবা রাজ্যেও

সারদা কাণ্ডে গ্রেফতার ইস্টবেঙ্গল-কর্তা


1

গ্রেফতারের পরে। সিবিআই দফতর থেকে বিধাননগর উত্তর থানার পথে দেবব্রত সরকার (নিতু)। বুধবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

সারদা-কাণ্ডে এ রাজ্যে ধরপাকড় শুরু করল সিবিআই।
তাদের প্রথম শিকার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু। ১৪ অগস্ট তাঁর পূর্ব সিঁথি রোডের বাড়িতে তল্লাশি করে কিছু নথি আটক করেছিল সিবিআই। আটক নথির সঙ্গে নিতুর বয়ান না-মেলায় বুধবার তাঁকে তলব করা হয় সিবিআই দফতরে। দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদের পরেও নিতুর বয়ানে অসঙ্গতি না-কাটায় সন্ধ্যায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। আজ, বৃহস্পতিবার তাঁকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তভার হাতে নেওয়ার পরে ১৬ অগস্ট ওড়িশার কংগ্রেস নেতা সমদিত কুন্তিয়াকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সেই অর্থে নিতু সিবিআইয়ের দ্বিতীয় শিকার। ১৪ তারিখ নিতুর পাশাপাশি রাজ্যের বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি চালান সিবিআই। তার মধ্যে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন আইপিএস অফিসার রজত মজুমদারও আছেন।
নিতু গ্রেফতার হওয়ার পর এই আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে পরপর বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রেফতার হতে পারেন বলে সিবিআই সূত্রের খবর। কেন্দ্রীয় সংস্থার গোয়েন্দারা বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে নিতু হচ্ছেন একটি কান। তাঁকে টানলেই মাথা আসবে। অর্থাৎ নিতুকে জেরা করেই আরও প্রভাবশালীদের পাকড়াও করা হতে পারে বলেই তাঁদের ইঙ্গিত।
নিতুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে সিবিআই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং তহবিল তছরুপের অভিযোগ এনেছে। কলকাতা থেকে কাশ্মীরে পালানোর আগে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন সিবিআই-কে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি অভিযোগ করেন, নিতুর সঙ্গে সেবি-র কয়েক জন কর্তার দহরম মহরম রয়েছে। তাই সেবিকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য নিতুকে কয়েক দফায় তিনি মোটা টাকা দিয়েছেন।
নিতুর সঙ্গে সঙ্গে ময়দানের আরও কয়েকটি ক্লাব এবং তাঁদের কর্তাদের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়নি সিবিআই। সারদা তদন্তে এর আগে মোহনবাগান কর্তা সৃঞ্জয় বসুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)। কিন্তু নিতুই ময়দানের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হলেন। সিবিআই সূত্রের খবর, নিতুর কাছ থেকে ময়দানের আর একটি ক্লাবে টাকা যাওয়ার কথাও তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। সেই ক্লাবের সঙ্গে শাসক দলের এক সাংসদ ও মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঘনিষ্ঠ এক নেতা যুক্ত। এ বার তা নিয়েও নিতুকে জেরা করা হবে। প্রভাবশালীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার চেষ্টাও করবেন গোয়েন্দারা।
সুদীপ্তর অভিযোগ
“ সেবি, কোম্পানি নিবন্ধক এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের সঙ্গে সারদার মধ্যস্থতাকারী ছিলেন নিতু। এদের নাম করে ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে টাকাও আদায় করতেন।” 
সিবিআইয়ের অভিযোগ
• তহবিল তছরুপ
• অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র।
এর পাশাপাশি সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো নিয়ামক সংস্থাগুলির ভূমিকাও খতিয়ে দেখবে সিবিআই। সারদায় সিবিআই তদন্ত দেওয়ার কথা জানানোর সময় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, নিয়ামক সংস্থাগুলির ভূমিকা খতিয়ে দেখা হোক। সিবিআই সূত্রের খবর, তদন্তে ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তা, কোম্পানি নিবন্ধকের এক জন এবং সেবি-র তিন কর্তার নাম উঠে এসেছে। তাঁদের টাকা যেত এক ‘মিডলম্যান’-এর মাধ্যমে। সুদীপ্তের অভিযোগ অনুযায়ী, নিতু-ই সেই ‘মিডলম্যান’। ১৪ তারিখ তল্লাশির সময় নিতুর বাড়ি থেকে সেবি-কে লেখা চিঠিও উদ্ধার হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে খবর। মিলেছে ২৫ লক্ষ টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট, যা নিয়ে নিতু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি, দাবি গোয়েন্দাদের। আগে নিতুকে রাজ্য পুলিশও জেরা করে। কিন্তু তারা কেন কোনও প্রমাণ বা কথাবার্তায় অসঙ্গতি পেল না, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তা নিয়েও।
সারদা-তদন্তে পিছিয়ে নেই ইডি-ও। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী অপর্ণা সেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা। ইডি সূত্রের খবর, রাজ্যের আরও তিন মন্ত্রী এবং শাসক দলের এক সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা। এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কশাল আদালতে আবেদন জানিয়েছে ইডি। ইডির অফিসারদের ধারণা, সারদার সঙ্গে ওই তিন মন্ত্রীর আর্থিক লেনদেন হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত কিছু নথিও উদ্ধার করা হয়েছে। ইডি সূত্রের খবর, সারদার একাধিক কর্মচারী ও হিসাবরক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, ওই তিন মন্ত্রী সারদার কাছ থেকে নানা ভাবে লাভবান হন। এক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা গিয়েছে। তিনি মাঝেমধ্যে সারদার মিডল্যান্ড পার্ক অফিসেও যেতেন। সারদার কাছ থেকে তিনি কয়েকটি গাড়ি নিয়েছেন বলেও তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন। রাজ্যের এক মন্ত্রী তথা দক্ষিণবঙ্গের আর এক বিধায়কের সম্পর্কেও কিছু তথ্য মিলেছে। তৃণমূলের এক সাংসদও সারদার থেকে লাভবান হয়েছেন বলে ইডি সূত্রের খবর। তাই টাকা পাচারের তদন্তে ওই তিন মন্ত্রী এবং সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলেই ইডির কর্তারা মনে করছেন। এক এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ব্যাপারেও তারা চিন্তাভাবনা করছে।
সারদা কেলেঙ্কারির মধ্যমণি সুদীপ্ত সেনকে এর মধ্যেই একাধিক বার জেরা করেছে ইডি। এ দিনই সারদা কনস্ট্রাকশনের মামলায় সুদীপ্তকে নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আলিপুর আদালতে আর্জি জানিয়েছে তারা। একই দিনে নিতুর গ্রেফতার ও সুদীপ্তকে হেফাজতে নিতে চাওয়ার আবেদন তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। এ বার দু’জনকে আলাদা ঘরে একই সময়ে জেরা করা হতে পারে। তাতে দু’জনের বয়ানের ফাঁক বেরোবে বলেই সিবিআই মনে করছে।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রয়াত কর্তা পল্টু দাসের হাত ধরে ১৯৭৬-’৭৭ সালে ময়দানে আসেন নিতু। ধীরে ধীরে ক্লাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা সামগ্রীর পারিবারিক ব্যবসা থাকলেও দিনরাত ক্লাবেই পাওয়া যায় তাঁকে। ময়দান সূত্রের খবর, ১৯৯১ সালে এএফসি কাপ খেলতে জাপান গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সঙ্গে যান বহু সমর্থক। অভিযোগ, তাদের অনেকেই আর দেশে ফেরেননি। ময়দানে ‘জাপান কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত সেই ঘটনায় নিতুর নাম উঠে এসেছিল। ক্লাবের তরফে তিনিই ভিসার বিষয়টি দেখেছিলেন বলে অভিযোগ।
ময়দানের লোকেরা বলছেন, প্রথম থেকেই রাজনৈতিক যোগাযোগ জোরালো ছিল নিতুর। পল্টু দাসের সূত্রেই মধ্য কলকাতার এক দাপুটে কংগ্রেস নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাম আমলে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা এবং এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপ্ত-সহায়কের সঙ্গে। এক সময় আলিমুদ্দিনে নিয়মিত দেখা যেত তাঁকে। রাজ্যে পালাবদলের পর নিতু তৃণমূলের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই মন্ত্রীর সঙ্গে সারদারও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ। ইদানীং নিতুকে রাজ্যের আর এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও তৃণমূলের এক পুর-নেতার সঙ্গেও দেখা গিয়েছে। অনেকেই বলছেন, নিতু প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্কের জোরেই ক্লাবে প্রভাব বাড়িয়েছিলেন। কার্যকরী সমিতির সদস্য হলেও ক্লাবে তিনিই শেষ কথা। তদন্তকারীদের সূত্রের খবর, সিবিআই-কে দেওয়া চিঠিতে সুদীপ্তও নিতুকে ক্লাবের ‘ডি ফ্যাক্টো সেক্রেটারি’ বলেছিলেন।
গোয়েন্দাদের তলব পেয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ কয়েক জন ঘনিষ্ঠকে নিয়ে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে হাজির হন নিতু। ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদের পর সামান্য সময়ের জন্য এক বার বেরোনও তিনি। ওইটুকু বাদ দিলে টানা জেরা চালান গোয়েন্দারা। বিকেলে সিবিআই সরকারি ভাবে জানায়, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দেবব্রত সরকারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, অনেক বিষয়ই এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন নিতু। “তাই শেষ পর্যন্ত দেবব্রতকে হেফাজতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তদন্তকারীরা,” মন্তব্য এক সিবিআই কর্তার।

পুরো বেতন চেকেই নিতাম, ব্যাখ্যা দিলেন অপর্ণা

ঋজু বসু

2

উদ্বিগ্ন। বুধবার নিজের বাড়িতে অপর্ণা সেন। ছবি: শৌভিক দে।

নিয়োগপত্রে খাতায়-কলমে যা লেখা, তার বাইরে তিনি সারদা-গোষ্ঠী তথা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে কানাকড়িও পাননি বলেই এ বার দাবি করলেন অপর্ণা সেন।
বুধবার আনন্দবাজারকে তিনি জানিয়েছেন, সারদা-গোষ্ঠীর প্রকাশিত মেয়েদের একটি পাক্ষিক পত্রিকা ও মিডিয়া স্কুলের সিইও হিসেবে নিয়োগের পরে যা পেয়েছেন, তা নিয়ে কোনও রকম ধোঁয়াশা নেই। অপর্ণার মন্তব্য, “সবটাই আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও আয়কর সংক্রান্ত নথিতে পরিষ্কার।” ঠিক দু’দিন আগে ইডি-র দফতরে টানা ছ’ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে অবশ্য সারদা-গোষ্ঠীর কাছে তাঁর বেতন-সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি তিনি।
কেন চাননি, এ দিন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন চিত্রপরিচালক-অভিনেত্রী। তাঁর বক্তব্য, ইডি-র দফতর থেকে বেরনোর সময়ে টিভি ক্যামেরার হুড়োহুড়ি ও প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কথা বলার পরিস্থিতি ছিল না। এ দিন সরাসরি তিনি বলেন, “মাইনের পুরোটাই আমি চেকে পেতাম। তার বাইরে কোনও লেনদেনই ছিল না।” ইডি সূত্রের খবর, খাতায়-কলমে অপর্ণার মাসিক বেতন ছিল ৭ লক্ষ টাকা। টিডিএস বাবদ খানিকটা কেটে তাঁকে ছ’লক্ষ টাকার কিছু বেশি দেওয়া হতো। এই তথ্যের সত্যতা মেনে নিয়েই অপর্ণা এ দিন জানিয়েছেন, ফিল্মজগতের পরিচিতি তথা সমাজ সচেতন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে তাঁর যা ব্র্যান্ডিং, তাতে এই টাকাটা অন্যায্য নয়। এ ছাড়া, কাজে যথেষ্ট সময়ও দিতেন তিনি।
তবু দায়িত্বশীল এক জন নাগরিক হিসেবে অপর্ণা সেন কেন সারদার মতো একটি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করলেন, এই প্রশ্নটাও শুরু থেকেই উঠছে। তিনি এ দিন সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন: গোড়ায় সারদার কয়েকটি সংবাদপত্রের সুবাদে তিনি তাদের প্রকাশনা সংস্থা বলেই জানতেন। বাংলা খবরের কাগজে একটি সাপ্তাহিক কলাম লিখতে শুরু করেন তিনি। পরে এক পরিচিতের মাধ্যমে ডেকে সুদীপ্ত তাঁকে পত্রিকা শুরু করার প্রস্তাব দেন।
তবে অপর্ণা বলেন, “ওটা (সারদা) যে চিট ফান্ড, তা শেষ দিকে বুঝতে পারি! কিন্তু ওই ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থা তো কতই আছে! ওদের যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র নেই, তা তো জানতাম না।” তবে বহু ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্র নির্মাণ বা পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে কার টাকা লগ্নি করা হচ্ছে, তা দেখা হয় না বলেও এ দিন মেনে নেন অপর্ণা।
কিন্তু ধরা পড়ার পর থেকেই সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেন বার বার বলে আসছেন, মিডিয়ার এই ব্যবসাই তাঁর ভরাডুবির কারণ। এর জন্য নামে-বেনামে বিপুল অর্থ তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে বলেও জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সেই সূত্রেই সুদীপ্তের ব্যবসায় অপর্ণা সেনের ভূমিকা কী  সরেজমিনে তদন্ত করে জানতে চায় ইডি। খাতায়-কলমে চুক্তির বাইরে নগদে কোনও টাকা দেওয়া হতো কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে তারা। তাঁকে যে বেতন দেওয়া হতো বলে সুদীপ্ত দাবি করেছেন, আর অপর্ণা যে টাকা পেতেন বলে জানিয়েছেন, তা মিলিয়ে দেখাটাও এই তদন্তের অঙ্গ।
অপর্ণা সেনের দাবি, দু’টি অঙ্কে বড়-সড় গরমিল নেই। তিনি বলেন, “সুদীপ্ত আমার ব্যাপারে কী বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটিও আমায় দেখানো হয়। প্রতি পাতায় আমায় সইও করানো হয়েছে। যা দেখলাম, সুদীপ্ত বরং কিছু কম টাকার হিসেব দিয়েছিলেন। হয়তো ওঁর কিছু ভুল হয়েছে। আমি জানিয়েছি, উনি (সুদীপ্ত) যা বলছেন, আমি তার থেকে একটু বেশি টাকা পেয়েছি।” এর বাইরে সারদা সংস্থা বা সারদার মিডিয়ায় তাঁর কোনও অংশীদারিও যে ছিল না, তা তিনি ইডি-কে স্পষ্ট জানিয়েছেন বলেই দাবি করেন অপর্ণা। এমনকী, পত্রিকার রোজকার কাজে সম্পাদক হিসেবে ছোটখাটো টাকা খরচের এক্তিয়ার পর্যন্ত তাঁর ছিল না বলেই এ দিন বলেন তিনি।
অপর্ণা বলেন, “কোনও মডেলের ফটোসেশনের জন্য টাকা দিতেও সুদীপ্তবাবুর সই করানো চেক লাগত। সব সময়ে উনি থাকতেন না, খুব দরকারেও ওঁর সঙ্গে সহজে দেখা করা যেত না! এতেও খুবই অসুবিধে হতো।” তবে অপর্ণার অধীনে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের মাইনে বা পদোন্নতির সুপারিশ অবশ্য তিনিই করতেন। নতুন কারও নিয়োগ হলে সেটাও তাঁর সম্মতিতেই হতো।
কিন্তু পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি যে মিডিয়া স্কুলের সিইও হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন, সেই সংস্থাটির অস্তিত্বই দেখা গেল না কেন? অপর্ণার বক্তব্য, “আমার কাছেও এটা হতাশার জায়গা! মিডিয়া স্কুলটার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাগিদেই আমি সারদায় যোগ দিই।” টালিগঞ্জের কাছাকাছি কোথাও সংস্থাটি খোলার পরিকল্পনা ছিল। তা হলে শিক্ষার্থীরা মাঝেমধ্যে টালিগঞ্জের স্টুডিওয় গিয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারতেন। অপর্ণার দাবি, “যে বছর দুয়েকের কাছাকাছি সারদার সঙ্গে ছিলাম, সেই সময়ের মধ্যে মিডিয়া স্কুলের জন্য পছন্দসই জমি পাওয়া যাচ্ছিল না বলে শুনেছি!”
তবে সারদায় যত দিন কাজ করেছেন, তার মধ্যে আবার বেশ কয়েক মাস তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা মাইনে পাননি বলে জানিয়েছেন অপর্ণা। তাঁর কথায়, “বোধহয় পাঁচ থেকে আট মাসের মাইনে বাকি আছে। এ ছাড়া, শুরুর দিকেও চেক বাউন্স করেছিল।” কিন্তু ঠিকঠাক বেতন না-পেয়েও এই চাকরি কেন ছেড়ে দিলেন না তিনি? অপর্ণার জবাব: “আমি ছেড়ে দিলে পত্রিকাটিই বন্ধ হয়ে যেত। আমার স্বামী যথেষ্ট রোজগার করেন। আমার নিজের জন্য চাকরিটা জরুরি ছিল না। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে আমার দীর্ঘদিনের সহযোগী অনেকে বেকার হতেন। সেটা হতে দিতে চাইনি!”
২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল এক সন্ধেয় হুট করেই একটি ই মেল-এর মাধ্যমে পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন অপর্ণা। এর পরে অন্য নামে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে আর একটি পত্রিকা শুরু করেন তিনি। ফিউচার এডুকেশনাল রিসার্চ ট্রাস্ট নামে একটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় সেই পত্রিকাটির সঙ্গে সারদা-গোষ্ঠী প্রকাশিত পাক্ষিকটির যে কোনও সম্পর্ক নেই, তা এ দিনও দাবি করেছেন অপর্ণা। পরে প্রকাশিত পত্রিকাটিও অবশ্য এখন বন্ধ। তার মালিকানার সঙ্গে সারদার সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে ইডিও খোঁজখবর করেছে।
এই বিষয়গুলি স্পষ্ট করতেই ইডি-র দফতরে তাঁকে ডাকা হয়েছিল বলে এ দিন দাবি করেন অপর্ণা। প্রধানত, ইডি-কর্তা যোগেশ গুপ্তর ঘরে বসেই তাঁদের কথা হয়। অপর্ণা ও তাঁর স্বামী কল্যাণ রায়ের জন্য চা, জলখাবার ও মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করাও হয়েছিল। কিন্তু ছ’ঘণ্টা কেন লাগল? অপর্ণার বক্তব্য, মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠানো হয়েছিল বলে তদন্তকারীরা তাঁকে নিয়েও কিছু ক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন। এ ছাড়া, তাঁর সারদা-সংস্রব নিয়ে সবিস্তার লিখিত বিবৃতি দেন অপর্ণা। পুরোটা লিখতে সময়ও লেগেছে।

চলছে অবাধে লুঠ, সারদার কারখানায় ঢুকে দেখল ইডি

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

3

ইডির অফিসারের হাত ধরে মিনতি সিমেন্ট কারখানার সুপারভাইজার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

প্রথমে বোলপুর, এ বার বেলিয়াতোড়।
সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের আশঙ্কা যে মোটেও মিথ্যা নয়, বুধবার বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে গিয়ে তা ফের চাক্ষুষ করলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) অফিসারেরা। দেখলেন, কারখানা বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে যন্ত্রাংশ ও মালপত্রের যেন হরির লুঠ পর্ব চলেছে! ঠিক যে ছবিটা তাঁরা মঙ্গলবার দেখেছিলেন, বোলপুরের কোপাইয়ে সারদার রিসর্টে তদন্তে।
বেলিয়াতোড় থানার ধবনী গ্রামে লোকসানে চলা ওই সিমেন্ট কারখানা ২০০৯ সালে সারদাকে বিক্রি করেছিলেন রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তা নিয়ে সোমবারই মন্ত্রীকে নিজেদের দফতরে ডেকে পাটিয়ে 
জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। এ বার ইডি হানা দিল সেই কারখানাতেই। মঙ্গলবারই সিউড়ি আদালত চত্বরে সুদীপ্ত সেন প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, রাজ্যের ভিতরে- বাইরে সারদার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাঁর আর্তি ছিল, “সম্পত্তিগুলো সব লুঠ হয়ে যাচ্ছে, ওগুলো বাঁচান!” সুদীপ্ত যে ভুল বলছেন না, তা এ দিন
ধবনীতে সারদার ‘ল্যান্ডমার্ক সিমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে ওই কারখানায় ঢুকে সম্যক টের পেয়েছেন ইডি-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মনোজ কুমার এবং এনফোর্সমেন্ট অফিসার এন কে মাসা।
বস্তুত, কারখানার হাল দেখে অবাক হয়ে যান ওই দুই অফিসার। এ দিন দুপুর প্রায় ১২টা নাগাদ তাঁরা ধবনীতে পৌঁছন। কারখানার মূল দরজায় তালা না দেখে চমকে ওঠেন। ভিতরে ঢুকে দেখেন কারখানা চত্বরে চরছে গরু, দোতলা অফিস ঘরগুলির দরজা, জানলা কিছুই নেই। এমনকী, দেওয়াল কেটে চুরি করা হয়েছে এসি মেশিনও। কারখানার পিছনের দিকের সীমানা প্রাচীরও প্রায় নিশ্চিহ্ন। কারখানার গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পড়ে রয়েছে হপার, ক্লিনারের মতো কিছু যন্ত্র এবং কয়েক বস্তা সিমেন্ট। বস্তাগুলির গায়ে লেখা ‘দুর্গাপুর সারদা সিমেন্ট’। ইডি-র আধিকারিকেরা অবশিষ্ট যন্ত্রপাতি এবং অফিস ঘরগুলির ছবি তোলেন।
এর পরেই তাঁরা ফোন করে ডাকেন ধবনীর বাসিন্দা অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি শ্যামাপ্রসাদবাবুর আমল থেকেই এই কারখানার সুপারভাইজার পদে কাজ করেছেন। বস্তুত, যে ১৮ বিঘা জমির উপরে এই সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ১৫ বিঘার মালিকই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। সেই পরিবারেরই অন্যতম সদস্য অশোকবাবু। বাকি জমি গ্রামের অন্য কয়েক জনের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। অশোকবাবু আসতেই কারখানায় চলতে থাকা লুঠতরাজ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। কারখানার মূল গেটে তালা রয়েছে, এই মর্মে তাঁদের কাছে খবর ছিল জানিয়ে সেই তালা কে বা কারা ভাঙল, তা-ও অশোকবাবুর কাছে জানতে চান। অশোকবাবু দাবি করেন, “২০১২ সালের শেষ দিকে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা কারখানার দিকে আর আসি না। কারা এই মালপত্র লুঠ করছে তার কিছুই জানি না।”
কারখানায় কত জন কর্মী ছিলেন, কোন সময় থেকে কারখানা বন্ধ হয়, শ্যামাপ্রসাদবাবুর আমলে কারখানার হাল কেমন ছিল, এ সব তথ্যও জানতে চাওয়া হয় অশোকবাবুর কাছে। পাশাপাশি ঠিক কতটা জমিতে এই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। অশোকবাবু জানান, পাঁচ একরের একটু বেশি জমিতে গড়া হয়েছিল কারখানা। পরে তদন্তকারীরা অশোকবাবুকে নিজেদের গাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে ফের একপ্রস্ত জেরা করেন। গাড়ি থেকে নেমে দৃশ্যতই ঘাবড়ে যাওয়া অশোকবাবু কেঁদে ফেলেন। ইডি-র অফিসারের হাত ধরে বলতে থাকেন, “স্যার, আমি কিছু করিনি। কিছু জানিও না।” একটু পরেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেন।
সারদার এই সিমেন্ট কারখানা দ্রুত নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে ইডি-র তরফে। ধবনীতেই তদন্ত শেষ করেননি ইডি-র দুই অফিসার। কারখানা থেকে বেরিয়ে অশোকবাবুকে সঙ্গে নিয়েই তদন্তকারীরা যান বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলা সাব-রেজিস্ট্রারের দফতরে। সেখানে কারখানার দলিল খতিয়ে দেখেন তাঁরা। পরের গন্তব্য, গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস। বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, সারদার সিমেন্ট কারখানাটি বড়জোড়া ব্লকে হলেও সেখানে রেজিস্ট্রি অফিস না থাকায় গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রার দফতরেই জমি রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। শ্যামবাবু যে জমি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কিনেছিলেন, তার তথ্য সংগ্রহ
করতেই তাই গঙ্গাজলঘাটি গিয়েছিলেন ইডি-র তদন্তকারীরা।
বিকেলে গঙ্গাজলঘাটি বাসস্ট্যান্ডে অশোকবাবুকে নামিয়ে চলে যায় ইডি-র দল। অশোকবাবু বাসে চেপে বাড়ি ফেরেন। পরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ওই কারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৫০ জন কাজ করতেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর থেকেই আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। বন্ধ হওয়ার আগে চার মাস আমরা বেতনও পাইনি।” তাঁর আর্জি, সরকার যে ভাবে সারদার একটি টিভি চ্যানেলকে অধিগ্রহণ করে চালাচ্ছে, সে ভাবে এই কারখানাও চালু করুক। আর ইডি-র জেরা প্রসঙ্গে অশোকবাবুর বক্তব্য, “আমি সামান্য কর্মী মাত্র। ভিতরকার ব্যাপার কিছুই জানতাম না। এ সব বড় বড় লোকেদের ব্যাপার! ইডি-র অফিসারদের সে কথাই বলেছি।”
তাঁর এক সময়কার মালিকানার সিমেন্ট কারখানায় ইডি-র হানা নিয়ে মন্ত্রী শ্যামবাবু বলেন, “এই সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র আমি আগেই ইডি-কে জমা দিয়েছি। যা জানানোর, তা-ও জানিয়েছি। ওদের তদন্ত, ওরা করবে!” আর কারখানায় লুঠপাট? মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত জবাব, “সারদাকে বেচে দেওয়ার পরে ওই কারখানা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি।”


No comments: